রোগব্যাধি নিয়ে মানুষের ওপর যত রকমের গবেষণা হয়েছে, সেখান থেকে একটা বিষয় খুব স্পষ্ট। কেউ যত কম ঘুমাবেন, তার আয়ু তত কমবে।
কাজেই বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত যদি বাঁচতে চান, শরীর সুস্থ রাখুন এবং রাতে ভালো করে ঘুমান।
ঘুম খুবই সার্বজনীন। এটা একেবারে বিনামূল্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। ঘুম স্বাস্থ্যের জন্য এতটাই ভালো যে প্রফেসর ওয়াকার এখন ডাক্তারদের সঙ্গে লবি করছেন প্রেসক্রিপশনে যেন তারা রোগীদের ঘুমের পরামর্শ দেন। ঘুম আপনার মস্তিষ্ক এবং আপনার শরীরকে জ্বালানী দিতে সাহায্য করে। কিশোর-কিশোরীদের আরও ঘুমের প্রয়োজন কারণ তাদের শরীর এবং মন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আপনার প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ ঘন্টা ঘুমের প্রয়োজন। যদিও আপনি সর্বদা এতটা পেতে সক্ষম নাও হতে পারেন, তবে যতটা সম্ভব চেষ্টা করা এবং অর্জন করা গুরুত্বপূর্ণ। ঘুম না হলে শরীর আর মনের ওপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে।
তবে ঘুমের উপকারিতা পেতে হলে সেটি হতে হবে স্বাভাবিক ঘুম- স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমালে হবে না। কারণ স্লিপিং পিল আবার ক্যান্সার, ইনফেকশন বা অন্য রকমের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
উন্নত বিশ্বে যত রকমের রোগ-ব্যাধিতে মানুষের মৃত্যু ঘটছে, তার অনেকগুলোর সঙ্গেই অনিদ্রার বেশ গুরুতর বা মোটামুটি রকমের সম্পর্ক আছে। যেমন: আলজেইমার, ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্থূলতা, ডায়াবেটিস, ডিপ্রেশন, দুশ্চিন্তা বা এমনকি আত্মহত্যা।
আপনার শরীরের ভেতর যত ধরনের তন্ত্র আছে, বা আপনার মস্তিস্কে যত রকমের নেটওয়ার্ক বা কাজ-কর্ম চলে, তার সবগুলোই কিন্তু ঘুমের সময় বিশ্রাম পায়। যখন আপনি যথেষ্ট পরিমাণে ঘুমাতে পারেন না, তখন এগুলোর কাজ-কর্ম ব্যাহত হয়।
সুস্বাস্থ্যের জন্য একজন মানুষের কতটা ঘুম দরকার:
খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর হচ্ছে সাত হতে নয় ঘন্টা।
আপনার ঘুম যদি সাত ঘন্টার কম হয়, তখন আপনার মস্তিস্ক এবং শরীরের ওপর এর কী প্রভাব পড়ছে তা মাপতে পারেন। আপনার শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং আপনার সজ্ঞানতা হ্রাস পেতে থাকে।
যদি আপনি একটানা ২০ ঘন্টা সজাগ থাকেন, অতিরিক্ত মদ পান করে মাতাল হলে যে অবস্থায় হয়, আপনার অবস্থাটা দাঁড়াবে সেরকম।
অনিদ্রা বা কম ঘুমের বেলায় যেটা সমস্যা, তা হলো, আমরা আসলে বুঝতে পারি না যে, এটি আপনার ওপর কতটা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।
কেন আমরা আগের চেয়ে কম ঘুমাচ্ছি তার অনেকগুলো কারণ আছে:
১. জ্ঞানের অভাব
যদিও ঘুমের ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা এখন অনেক কিছু জানেন, তারা সাধারণ মানুষের কাছে সেসব তথ্য পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছেন। বেশিরভাগ মানুষের আসলে ধারণাই নেই, ঘুম যে কতটা জরুরী। সুতরাং তারা যথেষ্ট সময় ধরে ঘুমানোর বিষয়টিকে মোটেই গুরুত্ব দিতে চান না।
২. ব্যস্ত জীবন
সাধারণভাবে বলতে গেলে, এখন আমরা অনেক দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছি, আর কাজে যাওয়ার জন্য রাস্তায়ও থাকছি অনেক দীর্ঘ সময় ধরে। কাজে যাওয়ার জন্য আমরা ঘর থেকে বের হই অনেক আগে, আর কাজ শেষে সন্ধ্যায় বাড়িতেও ফিরি অনেক দেরিতে। আমরা আমাদের সামাজিক এবং পারিবারিক জীবনকেও বাদ দিতে চাই না। কাজেই পরিবারের সদস্যদের সময় দেয়া, বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে ঘোরাঘুরি, টেলিভিশন দেখা.. এসব কিছুর পেছনেই কিন্তু সারাটা দিন চলে যায়। আর এত কিছুতে সময় দিতে গিয়ে যখন সময়ের টানাটানি পড়ে, তখন আমরা ঘুমের সময়টার ওপরই ভাগ বসাই।
৩. আমাদের বিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গী
ঘুমের একটা ভাবমূর্তির সংকটও আছে। যদি আপনি কাউকে বলেন যে আপনি দিনে নয় ঘন্টা ঘুমান, তারা আপনার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলবে, সত্যিই তাই! তাদের মাথায় হয়তো তাৎক্ষণিক এই চিন্তাটাই আসবে, লোকটা এতটা অলস!
কাজেই বেশি ঘুমানোকে এখন খারাপ চোখে দেখা হয়। লোকজন এখন কত কম ঘুমায় সেটা নিয়ে বড়াই করে বেড়ায়। কিন্তু ব্যাপারটা সবসময় এরকম ছিল না।
যখন একটি শিশু ঘুমায়, কেউ কিন্তু বলবে না, বাচ্চাটা কি অলস। কারণ আমরা জানি যে, একজন শিশুর জন্য ঘুমটা কত জরুরী। কিন্তু শৈশবের সঙ্গে আপনার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনটা যদি মিলিয়ে দেখেন, তাহলে বুঝবেন, কোথাও একটা বিরাট তফাৎ ঘটে গেছে।
ছোট থেকে বড় হতে হতে আমরা ঘুম যে জরুরী, এই ধারণাটা আসলে পরিত্যাগ করি। বরং যারা বেশি ঘুমায়, তাদের আমরা গালমন্দ করি।
৪. আমাদের পরিবেশ
আমরা এখন বাস করি আঁধার থেকে বঞ্চিত এক সভ্যতায়। অথচ আঁধার কিন্তু আমাদের দরকার। যাতে করে আমাদের শরীরে 'মেলাটনিন' নামের একটি হরমোন নিঃসরণ হয়। এটি আমাদের একটি ভালো এবং স্বাস্থ্যকর ঘুমের জন্য খুব জরুরী।